আমরা আমাদের কষ্টার্জিত অর্থের সুরক্ষার ব্যাপারে সকলেই চিন্তিত। সঠিক জায়গায় অর্থের বিনিয়োগ এবং সেখান থেকে উপযুক্ত রিটার্ণ আমাদের মূল্য বৃদ্ধির থেকে সুরক্ষা দিতে সক্ষম। টাকা–পয়সা লগ্নির যে চিরাচরিত উপায় গুলি রয়েছে যেমন ফিক্সড ডিপোজিট, প্রভিডেন্ট ফান্ড, সেভিংস ব্যাংক ইন্টারেস্ট, পোস্টাল সেভিংস স্কিম, সুকন্যা সমৃদ্ধি যোজনা – এগুলি আমাদের কখনোই সেই কাঙ্ক্ষিত রিটার্ন দিতে পারে না যাতে আমরা মূল্যবৃদ্ধির সাথে তাল মেলাতে পারি।
এই বিনিয়োগ গুলি যেহেতু ঝুঁকিহীন তাই এইগুলি আমাদের উচ্চ হারে রিটার্ন দিতে সক্ষম হয় না গড়ে ৬.৫ শতাংশ থেকে ৮.৫০ শতাংশ হারে এই বিনিয়োগগুলি রিটার্ন দিয়ে থাকে যেখানে আমাদের বার্ষিক মুদ্রাস্ফীতি গড়ে ৭.৫%। অর্থাৎ আপনার নিকটে থাকা সঞ্চিত অর্থের প্রতি ১০০ টাকার মূল্য বছরে ৭.৫ টাকা কমে যাচ্ছে। আজ আপনি ১০০ টাকা খরচ করে যে দ্রব্য বা পরিষেবা ক্রয় করছেন বাজার থেকে আগামী বছর সেই পরিমাণ দ্রব্য বা পরিষেবা ক্রয় করতে আপনাকে ১০৭ বা ১০৮ টাকা খরচ করতে হবে।
তাই আপনি যদি মনে করেন চিরাচরিত ব্যাংকে বা পোস্ট অফিসে উপলব্ধ স্কিমগুলিতে বিনিয়োগ করে অর্থ সঞ্চয় করে আপনার ভবিষ্যৎ লক্ষ্য পূরণ করবেন তাহলে সেই ভাবনা ভুল হতে পারে। তাহলে উপায় ?
বিগত বছরের তথ্য বিশ্লেষণ করে বলা যায় যে ঝুঁকিপূর্ণ বিনিয়োগই অতীতে মূল্যবৃদ্ধির সাথে লড়াই করতে সাহায্য করেছে কিন্তু ঝুঁকিপূর্ণ বিনিয়োগ বলতেই আমাদের মনে যেটা প্রথম আসে তা হল শেয়ার মার্কেটে অর্থলগ্নি। বাস্তবেই এই লগ্নি ঝুঁকিপূর্ণ, কিন্তু এটাও সত্যি যে এখানে লগ্নি করে বিনিয়োগকারীরা প্রভুত অর্থসম্পদ সঞ্চয় করতে পারেন। বাজারে অর্থ বিনিয়োগ করে ধনী হওয়া ব্যক্তিদের তালিকা নেহাত কম নয় রাকেশ ঝুনঝুনওয়ালা, ওয়ারেন বাফেট এর নাম এ প্রসঙ্গে সবার আগে উল্লেখযোগ্য।
শেয়ার মার্কেটে বিনিয়োগ দুরকম হতে পারে প্রত্যক্ষ বিনিয়োগ ও পরোক্ষ বিনিয়োগ প্রত্যক্ষ বিনিয়োগে আমরা নিজেরাই নিজেদের অভিজ্ঞতা থেকে বিভিন্ন শেয়ার কিনে তা পরবর্তীতে সরাসরি শেয়ার মার্কেটে বিক্রয় করতে পারি শেয়ার কেনাবেচা এই পদ্ধতি হলো প্রত্যক্ষ বিনিয়োগ যেখানে উপযুক্ত জ্ঞান এবং অভিজ্ঞতা না থাকলে এই শেয়ার কেনা বেচায় অনেক আর্থিক ক্ষতির ঝুঁকির সম্ভাবনা থাকে, কারণ আমরা যখন কোম্পানির শেয়ারগুলি ক্রয় করি সবসময় সেই কোম্পানির সম্পর্কে সম্মুখ ধারণা আমাদের থাকে না বা এমনও হয়ে থাকে অনেক সময় ভালো প্রফিটে চলা কোম্পানি হঠাৎ করে কিছুদিন লসে চলতে আরম্ভ করলে সেই কোম্পানির শেয়ার দেওয়ার বিপুল পরিমাণে পতন হতে থাকে এক্ষেত্রে সেই কোম্পানিতে বিনিয়োগ করা ব্যক্তি প্রভূত ক্ষতির সম্মুখে পড়ে।
প্রত্যক্ষ বিনিয়োগের এই ধারা এই ধারা ছাড়াও আরেকটি আরেকটি উপায়ে শেয়ার মার্কেটে বিনিয়োগ করা যায় তা হল মিউচুয়াল ফান্ড বিনিয়োগ। এখানে আপনি কোন নির্দিষ্ট মিউচুয়াল ফান্ড কোম্পানিতে অর্থের বিনিময়ে বিশেষ কোনো মিউচুয়াল ফান্ডে বিনিয়োগ করেন যে ফাণ্ডটিতে বহু বৈচিত্রপূর্ণ স্টক বা শেয়ারের সমাবেশ থাকে এবং এই ফান্ডটি পেশাদার পরিচালক কর্তৃক পরিচালিত হয়।
প্রত্যক্ষ শেয়ার কেনাবেচায় আপনি নির্দিষ্ট একটি শেয়ারে আপনি অনেকগুলি টাকা লগ্নি করে থাকেন সেখানে মিউচুয়াল ফান্ড সিস্টেমে আপনার টাকা অনেকগুলি কোম্পানিতে একসাথে বিনিয়োগ হয়। তাই কোন একটি কোম্পানির দুরবস্থায় আপনার অর্থ হারানোর ঝুঁকি কমে যায়, একে বলে পরোক্ষ বিনিয়োগ, কারণ এই বিনিয়োগ ব্যবস্থায় আপনার অর্থ শেয়ার মার্কেটে প্রযুক্ত হচ্ছে ঠিকই কিন্তু সরাসরি আপনি ক্রয় করছেন না আপনার হয়ে একটি নির্দিষ্ট ফান্ড এবং তার ম্যানেজাররা এটি ক্রয় করে থাকে। তাদের অভিজ্ঞতালব্ধ জ্ঞান এক্ষেত্রে তারা স্টক নির্বাচন বা ক্রয়ের ক্ষেত্রে কাজে লাগান তাই আমাদের মতো অনভিজ্ঞরা এখানে সরাসরি শেয়ার ক্রয় করেনা
এবার আমরা দেখে নেব মিউচুয়াল ফান্ড ব্যবস্থায় ঝুঁকি কতটা ? প্রথমত যে কথা আগেই বলা হয়েছে মিউচুয়াল ফান্ড প্রফেশনাল ম্যানেজমেন্ট কর্তৃক পরিচালিত হয়। নির্দিষ্ট দক্ষতা এবং অভিজ্ঞতার ভিত্তিতেই তাদের সেখানে নিযুক্ত করে বিভিন্ন ফান্ড হাউস গুলি; যেমন এসবিআই মিউচুয়াল ফান্ড এইচডিএফসি মিউচুয়াল ফান্ডস নিপন ইন্ডিয়া মিউচুয়াল ফান্ড ইত্যাদি। যারা শেয়ার মার্কেটে পরোক্ষভাবে লগ্নিকারীদের অর্থ বিনিয়োগ করে সেই কোম্পানিগুলিই এই ফান্ড ম্যানেজারদের নিয়োগ করে থাকে। একজন ফান্ড ম্যানেজার ক্রমাগত বিনিয়োগের উপরে নজরদারি করেন এবং সেই স্কিমের উদ্দেশ্য পূরণের জন্য সেই অনুযায়ী সেই ফান্ডের পোর্টফোলিওর ভারসাম্য বজায় রাখেন। পেশাদার ফান্ড ম্যানেজারের মাধ্যমে তাই মিউচুয়াল ফান্ড বিনিয়োগের এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ সুবিধা।
কেন মিউচুয়াল ফান্ডে বিনিয়োগ কম ঝুঁকিপূর্ণ
আমরা সব সময় শুনে থাকি যে মিউচুয়াল ফান্ডে বিনিয়োগ ঝুঁকিপূর্ণ কিন্তু এই ঝুঁকিকে যদি বৈচিত্র্যপূর্ণ করা যায় তাহলে সেই ঝুঁকে অনেকটাই কমে যায়। মিউচুয়াল ফান্ডে সঞ্চয় করা আপনার অর্থ যে সবসময় শেয়ারেই লগ্নি হয় তা কিন্তু নয়, শেয়ারের পাশাপাশি বিভিন্ন সরকারি ঋণ প্রকল্প এবং সোনা ক্রয় করতেও ব্যবহার করা হয় যা আমাদের অর্থের ঝুঁকি ছড়িয়ে দিতে সাহায্য করে। তাই আপনার সমস্ত ডিম যখন একটি ঝুড়িতে থাকবেনা তখন স্বাভাবিকভাবে সেই ডিম গুলি সুরক্ষিত থাকার সম্ভাবনা বেশি।
মিউচুয়াল ফান্ডে বিনিয়োগের বাড়তি আরেকটি সুবিধা হল আপনি এখানে খুব সামান্য পরিমাণ অর্থ সঞ্চয় করতে পারেন কারণ কোন বিনিয়োগকারির পক্ষেই একইসঙ্গে ২০০ টি কোম্পানির শেয়ার – যে কোম্পানি গলিতে মিউচুয়াল ফান্ড হাউস গুলি বিনিয়োগ করছে – সেই শেয়ারগুলি একসাথে ক্রয় করা কখনোই সম্ভব নয় কিন্তু মিউচুয়াল ফান্ডের মাধ্যমে প্রত্যেকটি কোম্পানিতে আমার আপনার লগ্নির সামান্য অংশ বিনিয়োগ হয় তাই স্বল্প বা যেকোন আয়ের অতি সাধারণ ব্যক্তি মিউচুয়াল ফান্ডে যেকোন এমাউন্ট বিনিয়োগ করে লাভবান হতে পারেন। মিউচুয়াল ফান্ডে বিনিয়োগ করার জন্য যে আপনাকে উচ্চ–আয় সম্পন্ন হতে হবে সবসময় কিন্তু তা নয়।
লিকুইডিটি আরেকটি আকর্ষণীয় বিষয় যা মিউচুয়াল ফান্ড কে অন্যান্য ইনভেস্টমেন্ট থেকে আলাদা করে। আপনি যখন আপনার কোন সম্পদ যেমন ধরুন আপনার হাতে থাকা একটি গাড়ি কিংবা আপনি নিজের প্লট বা জমি বিক্রয় করতে যাবেন আপনি কিন্তু তৎক্ষণাৎ নির্ধারিত বাজার মূল্য অনুযায়ী সব সময় তা বিক্রয় করার ব্যক্তিকে খুঁজে পাবেন না অর্থাৎ চাইলে কিন্তু আপনি আপনার সম্পদকে অর্থে পরিণত করতে পারবেন না। কিন্তু মিউচুয়াল ফান্ডে আপনি আপনার সঞ্চিত অর্থকে যখন তখন বিক্রি করে সেই অর্থকে নিজের একাউন্টে ক্রেডিট করতে পারবেন। সাধারণত মিউচুয়াল ফান্ডে আমরা যখন অর্থ বিনিয়োগ করি সেই অর্থ ইউনিটের আকারে আমাদের মিউচুয়াল ফান্ড অ্যাকাউন্টে জমা হয়। সেই জমাকৃত ইউনিট গুলি ওই ফান্ডের NAV অনুসারে আপনি খুব সহজেই বিক্রয় করতে পারবেন। বিক্রয় বা এক্ষেত্রে রিডিম করার পরে আপনার ব্যাংক একাউন্টে সাধারণত তিন থেকে চার দিনের মধ্যে সম্পূর্ণ অর্থ জমা হয়ে যায়। যদিও আপনি যদি কোন ইএলএসএস ফান্ডে বিনিয়োগ করে থাকেন যেখান থেকে আপনি 80/ ধারা ট্যাক্স ছাড় পেয়ে থাকেন সেখানে কিন্তু তিন বছরের একটি লক পিরিয়ড থাকে তারপরে আপনি যেকোনো সময় সেই ফান্ড আপনি বাজারে বিক্রি করতে পারেন।
প্রতিটি সার্ভিসই আমরা কোন না কোন অর্থের বিনিময়ে পেয়ে থাকি। এই মিউচুয়াল ফান্ডে বিনিয়োগ করে অর্থ উপার্জন এটা একটি পরিষেবা, যেটা আমরা সরাসরি নিজেরা করতে পারিনা কোন ফান্ড হাউসের মাধ্যমে করে থাকি। তাই আমাদেরকে নির্দিষ্ট পরিমাণ অর্থ প্রদান করতে হয় তার বিনিময়ে মিউচুয়াল ফান্ড হাউসগুলিতে। মিউচুয়াল ফান্ডের ক্ষেত্রে এর বাড়তি সুবিধা হল এখানে আপনি খুব অল্প অর্থের বিনিময় এই ফান্ডটিতে ব্যবস্থাপনা করতে পারেন।
কোন আর্থিক ব্যবস্থাপনা সবসময় সরকারি নিয়ন্ত্রণাধীন হওয়া উচিত মিউচুয়াল ফান্ডের ক্ষেত্রে এর ব্যতিক্রম নেই সেবি বা সিকিউরিটিস এন্ড এক্সচেঞ্জ বোর্ড অফ ইন্ডিয়া এই মিউচুয়াল ফান্ড কে নিয়ন্ত্রণ করে থাকে তাই ফাণ্ডহাউস গুলি আপনার আমার সঞ্চিত অর্থ নিয়ে নয়–ছয় করার সম্ভাবনা দিকটি এক্ষেত্রে একেবারেই কম।
এভাবে আমরা দেখতে পাই যে মিউচুয়াল ফান্ডে আর্থিক বিনিয়োগ প্রত্যক্ষ বিনিয়োগে আর্থিক ঝুঁকি সরাসরি শেয়ার কেনাবেচার থেকে অনেকটাই কম।
( সংবিধিবদ্ধ সতর্কীকরণ: উপরিউক্ত আলোচনা এবং বিশ্লেষণ সম্পূর্ণ সচেতনতামূলক। প্রতিবেদনটি কোনরকম শেয়ার মার্কেটে আর্থিক বিনিয়োগকে উৎসাহিত করবার জন্য রচিত নয় বিনিয়োগকারীরা নিজেদের অর্থ লগ্নি করার সময় ব্যক্তিগত অর্থ ব্যবস্থাপনা বিশেষজ্ঞদের মতামত নিয়ে অর্থ বিনিয়োগ করুন)